দশ দিগন্তে উড়ালঃ বৈরিতা নয় ভালোবাসাই প্রাপ্য


মা
নুষের সাথে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়িয়ে মোটামুটিভাবে আমার দিনগুলো কাটাতে পারছি, এটা একধরনের সাফল্যই বলা যায়। কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা লিখতে গেলে অযথা বিরোধে পড়ার অশঙ্কা। চাই মোটামুটিভাবে নির্বিরোধ দিন কাটিয়ে দিতে চাই। আর ক’দিনই বা বাকি আছে। লিখতে গেলে একটু বেশি ভেবেচিন্তে লিখতে হচ্ছে। কে কোন কথাটায় আঘাত পায় সেটা বিবেচনা করে লিখতে চাই। অন্ধেরও দিন কেটে যায়। তারও একটা স্বপ্ন-কল্পনার জগৎ থাকে। সেই জগতে সাধারণত কৈফিয়ত দিতে হয় না বলে মনে হলেও বিবেক সব সময় সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। ফলে যতটা সতর্ক হওয়া উচিত তারও বেশি সতর্ক হয়ে চলতে গিয়ে বুঝতে পারছি যে এভাবে লেখালেখি চালিয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত লেখাই বন্ধ হয়ে যাবে। লেখাটা চালিয়ে যেতে চাই। আমার পাঠক আছে। প্রকাশকও আছে। এর মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের একটা আমন্ত্রণ বাতিল করতে হয়েছে। শারীরিক অক্ষমতা তো আছেই, পারিবারিক দুর্দশাও আমাকে ঘিরে রেখেছে। তা হলেও আমি তো একেবারে কিছু না লিখে দিন কাটাতে পারছি না।

অন্য দিকে লেখার বিষয়বস্তু অনেক থাকলেও পরিশ্রমের ভয়ে কেবল এড়িয়ে চলতে চাইছি। চাই প্রীতিপূর্ণ কিছু লিখতে। কিন্তু লেখা শুরু করলেই হয়ে যায় অপ্রীতিকর কিছু।
আমার মতো বৃদ্ধ লোকের বিষয় নির্বাচন অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। তবুও সব জটিলতাকে সহজতর করে একটা পরিচ্ছন্ন প্রতিকৃতি অর্থাৎ আমার চেহারার মতো স্পষ্ট কিছু উত্থাপন করতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। জানি না কতটুকু সফল হবো। আপাতত নিজের মুখের মতোই একটা কিছু খাড়া করতে প্রয়াসী হচ্ছি।

এখানে একটা কথা অকপটে স্বীকার করে নিতে চাই যে, ইচ্ছা করলেই সব কিছু নিজের আয়ত্তে রাখতে পারি না। তা ছাড়া আমার শত্রুও আছে, যারা সব সময় আমার খুঁত খুঁজে বেড়ায়। আমি এদের সমীহ করে চলি, চলতে চলতে বহু দূর চলে এসেছি। আমি বুঝি আমার আয়ুষ্কালের একটা বড় অংশ অতিবাহিত করে ফেলেছি। বাকি দিনগুলো কোনো প্রকার হিংস্রতা ও শত্রুতার মধ্যে কাটাতে চাই না। মানুষকে ভালোবাসি এবং কোনো জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করাকে আমার নিজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করি। লেখালেখির জীবন বেছে নিলে শত্রুতা ও হিংস্রতা একদম বাদ দিতে হবে। এ পর্যন্ত যে জীবন কাটিয়ে এসেছি সে দিকে ফিরে তাকাতে গেলে খুবই অন্তর্জ্বালার সৃষ্টি হয়। সে জন্য আমার প্রায়ান্ধ চোখ আর অতীতের দিকে দেখতে চায় না। শুধু অতীত কেন, অজানা ভবিষ্যতের দিকেও আমার পক্ষে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবুও মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। বিশ্বাস করেছিলাম। এর প্রমাণ সম্ভব হলে রেখে যেতে চাই। বারবার বলছি আমার শত্রুদের সাথে সঙ্ঘাত, সংশয় ও অবিশ্বাস এড়িয়ে চলতে চাই। জানি না সফল হবো কি না, কিন্তু আমার আন্তরিকতা ত্যাগ করব না।

লিখতে চেয়েছিলাম অনেক বড় কিছু। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবেগ-অনুভূতির মর্মজ্বালা আমাকে শত খণ্ডে বিভক্ত করে ফেলেছে। একটি বইয়ে একটি জীবন রচনা করা বোধ হয় আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আগেই বলেছি আমাকে খুঁজতে হলে এই মহানগরীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেতে হবে পথে-প্রান্তরে, মাঠেঘাটে। যেখানে একদা ছিলাম এবং এখনো মনেপ্রাণে সেখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি।
আমার জীবনে অনেক মানুষের স্মৃতি আছে। এই স্মৃতি কখনো চেহারা হয়ে স্মরণে ভাসছে কিংবা স্পর্শের বেদনা হয়ে অস্তিত্বে লেগে আছে। কে আছেন এমন লেখক বা কবি যিনি নিজের সব কথা উজাড় করে লিখতে পারেন। আমি তো পারি না। আমাকে যারা চেষ্টা করে দেখতে পরামর্শ দেন তাদের প্রতি আমার অনুরোধ হলো আমার লেখালেখির ব্যাপারে কোনো পরামর্শ দেয়া সম্ভবত ঠিক হচ্ছে না। আমি তো লিখেই যাচ্ছি। কলম বন্ধ করছি না।
মানুষের জীবন হলো মহাকাব্যের সগোত্র। লিখতে পারলে ভালো। না লিখতে পারলেও ক্ষতি নেই। একদিন উদঘাটিত হয়ে যাবে। এই বিশ্বাস নিয়েই অনন্তে মিশে যাবো।

পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে কোনো মানুষই অন্তিমে পৌঁছায় না। আমারও হাহাকার আছে, কিন্তু হতাশা নেই। হতাশ হবো কেন? আমি কি যথেষ্ট লিখিনি? যা প্রকাশ করার তা প্রকাশিত হচ্ছে। আর যেটুকু অপ্রকাশে বেদনায় ভরা, সেটা বলতে পারিনি। পৃথিবীতে চলতে হলে বলার চেয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিতে হয়, আমি সেটাই করেছি। শত্রুতা পরিহার করে চলতে গিয়ে শত্রুতাকেই ডেকে এনেছি। এখন শত্রুতার কাছে আমার আত্মসর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর জানি, শত্রুরা আমাকে কখনো নিষ্কৃতি দেবে না। এ রকম একটি প্রসঙ্গে পৌঁছে গেছি, যেখানে সবাই পরাজয় মানে; কিন্তু আমি মানি না। পরিণাম যা-ই হোক, এ পর্যন্ত যা লিখেছি সে সবই আমার আত্মরক্ষায় ভালো হবে। কবি হিসেবে জন্মেছিলাম। আর ঘোষণা করেছিলাম, পরাজিত হয় না কবিরা। এই নীতিতে এখনো অটল আছি। এই যে লিখছি এটাই তো আমার বিজয় পতাকা। পরাজিত হয়ে পালাইনি, কোথায় পালাব। এ দেশে পরাজিত মানুষকে কেউ আশ্রয় দেয় না। আর আমি তো কবি। আমাকে কে প্রশ্রয় দেবে? তার চেয়ে বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন, পতন এলে ধুলায় গড়াগড়ি যাবো। লেখাই আমার অস্ত্র, সেটা পতনের মুহূর্তেও আমার দক্ষিণ হস্তে ধরা থাকবে।

আমি ভালোবেসেছিলাম। প্রতিদান পাইনি বলে আমার ভালোবাসাকে তো আর ফিরিয়ে নিতে পারব না। আমার দেশ, আমার ভাষা একদিন না একদিন আমার কথা বলবে। কারণ নিজেই আমার জীবনকাহিনী তৈরির উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে যাচ্ছি। কেউ না কেউ একদিন এসব গেঁথে তুলবে। আমার ঋণ আছে; কিন্তু ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় নেই আমার হাতে। যদি পৃথিবীতে ক্ষমতা বলে কোনো জিনিস থেকে থাকে তাহলে তা আমার জন্য লভ্য হবে না কেন? আমি কি এক মুহূর্তের জন্য চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম? বিশ্রাম বা বিরাম উপভোগের ছুতো খুঁজেছিলাম। লেখালেখি বীরের কাজ। আমি সেটা ঠিকমতোই আঞ্জাম দিয়েছি। আবারো বলি, পরাজিত হয় না কবিরা। পৃথিবীতে মানুষ তার সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না। আমিও পারিনি। আমার কাজ ছিল কবি হিসেবে আমার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো, তা দেখিয়েছি। এখন কোন উপাদানে এই স্বপ্ন সৃষ্টি করেছিলাম সেটার কৈফিয়ত আমি দেবো না। আমার কাজ করে চলে গেছি। কিছু লোক থাকবেই যারা খুঁত খুঁজে বেড়াবে। যারা কিছু করে না, তারা দোষত্রুটি ধরে।

আমি করেছি অনেক। কত দিকে তারা ত্রুটি খুঁজবে? আমার জীবনের মতোই আমার সরলতা। কাউকে আঘাত করিনি। কাউকে পরাজিত করতে চাইনি। অথচ আমি একজন কবি ছাড়া আর কিছু নই। আমারও হয়তো বা বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। এ কারণেই শত্রু খুঁজি না, বন্ধু খুঁজি। প্রীতি-ভালোবাসা খুঁজি। আমার মধ্যেও অহংবোধ আছে, যা না থাকলে জগৎ সংসারে কেউ কবি হয়ে জন্মায় না। স্বপ্ন দেখিয়েছি, কিন্তু এর কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করিনি। এখন তো আমার দিন কাটিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বিদায়ের আলো যতই বিমর্ষ হোক, আমার মুখে পড়ে আমাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। শুধু বন্ধুত্বই চেয়েছি। এখন ভালোবাসাই আমার প্রাপ্য, বৈরিতা নয়।

লেখকঃ কবি ও কথাশিল্পী
— আল মাহমুদ

সুত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৯/০৭/২০০৯

2 responses to this post.

  1. good love litter need so thank you

    Reply

  2. good love liter

    Reply

Leave a comment