দশ দিগন্তে উড়াল : কলমের কালি কখনো শুকায় না


নি
জের দুঃখের ভারে কুঁজো হয়ে ঘরে বসে আছি। আমার মতো বয়স্ক কবির জন্য কোনো আশার বাণী নেই। প্রত্যাশার বুদবুদ নেই। অথচ মনে হয়, আমার জাতির জন্য আমার যা করণীয় ছিল, তা করেছি। তখন বুঝতে পারিনি, কাজ করছি তার কোনো পুরস্কার তো নেই-ই, তিরস্কারও নেই। কোথাও কোনো এক বিন্দু আশার রস নিঃসৃত হচ্ছে না। তবুও আছি আমার মতো। নিজের দুঃখের ভার বয়ে নিয়ে চলেছি। চলেছি ভবিষ্যতের দিকে, যে ভবিষ্যৎ আমার কাছে একেবারেই অস্পষ্ট। আমি যে আছি, এটা আমার নিজের কাছে বিস্ময়বোধ হয়। এত দুঃখকষ্ট, রোগশোক এবং পারিবারিক স্থবিরতার মধ্যে শুধু আমারই নড়াচড়ার শক্তি আছে। জানি না কোন পুণ্য বলে এই শক্তি অর্জন করেছি। লিখে চলেছি যেখানে আর কথার বাক্য ফোটে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ নেই আমার। তবে নিজের দীর্ঘ জীবনের অন্তিমে এসে সবাই কিছু পরিণাম আশা করে। কিছু চাইনি বলে আমার হাতে কয়েকটি কররেখা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অথচ আমি অন্ধ বলে কোনো কিছুই তো আর বন্ধ থাকবে না।
বড় কাজ করতে চেয়েছিলাম। হয়তো সামর্থ ছিল, কিন্তু করতে পারিনি। এমন একটি জীবনীগ্রন্থ তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কবি-সাহিত্যিকদের সতর্কবাণীর আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমি তো দিনরাত সমানে লিখছি; বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই; কিন্তু এসব লেখায় আমার মন ভরছে না কেন? আমার সৃজনশীলতা কি নিঃশেষিত? নিজেকে এই প্রশ্ন করে নিজেই জবাবহীন অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পৃথিবীতে অনেক দুঃখেরই কোনো অবসান কবিরা খুঁজে পাননি। আমি কি পাবো? পাই বা না পাই আমি জীবন সম্বন্ধে হতাশ নই। তবে হয়রান হয়েছি।

সব লেখাই এক অর্থে আমার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। নিজের মুখের রেখাচিত্র তৈরি করে চলেছি। একবার লিখছি আবার নিজেরই আঁকজোখ মুছে ফেলে ক্লান্ত হয়ে বসে আছি। আমার সৌভাগ্য এটুকুই যে, লেখাটা বাদ দিইনি কিংবা বলা যায় বাদ দিতে পারিনি। দেখেছি, আমার সম্পর্কে কিছু মানুষের কৌতূহল ছিল। আবার কিছু মানুষের বিদ্বেষও ছিল। যারা আমার সম্বন্ধে কৌতূহলী ছিলেন, তারা আস্তে আস্তে কালের নিয়মেই কালচক্রে মিশে গেছেন। আর যারা আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন তারা অবশ্য আমার কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও কুৎসা রটিয়ে অন্তর্হিত হয়েছেন। আমি আছি আমার মতো। এ অবস্থাকে ভালোও বলা যায় না, আবার একেবারে মন্দও বলা যায় না। আমার পরিণাম হবে আর দশজন কবির মতোই, আমি পরাভব স্বীকার করিনি। তবে বিজয়ী হয়েছি, এটাও তো বলা যাবে না। শুধু একটা কথা এখনো বলা যায়, সেটা হলো আমি লিখছি এবং পরিসমাপ্তির দিকে এগোচ্ছি। কিসের পরিসমাপ্তি তা আমার অজ্ঞাত। আমার বয়সী আর কোনো নিয়মিত লেখক আমার চোখে পড়ছে না। আর যারা আমার কথা অন্তত একেবারে ভুলে যাননি তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে প্রবাসযাপন করছেন। তাদের জন্য আমার সহানুভূতির সীমা নেই।
বহুবার বলেছি, আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই বাংলাদেশকে, অন্তরে-বাইরে, তারপর লিখতে চাই, লিখতে লিখতে শিখতেও চাই। কিন্তু এই দেখার কাজটা আমার জন্য এখন প্রায় প্রতিরুদ্ধ। কারণ কে এক বৃদ্ধকে হাত ধরে নিয়ে যাবে তার ভবিষ্যতের দিকে? আমার জন্য সবচেয়ে সেরা কাজ হতো বালক থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত একটি ইতিবৃত্ত তৈরি করা। পারছি না, কারণ আমার হৃদয় অশান্ত। অস্থিরমতি নিয়ে কোনো সৃজনশীল বৃহৎ কাজ আঞ্জাম দেয়া যায় না। অন্য দিকে বিচার করলে তো লেখালেখির ব্যাপারে এখনো শ্রান্ত হয়ে পড়িনি। কেউ সাহায্য করলে এখনো অনর্গল বলে যেতে পারি। আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে­ এত দিন লিখছি, এর পাঠক আছে কি না। কারণ লেখকের পরমাত্মীয় হলো একজন পাঠক বা পাঠিকা। সেটা পড়ছে কি না। অবশ্য সাড়া পাই। আকস্মিকভাবে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে আমার ঘরেও টেলিফোন বেজে ওঠে। কণ্ঠস্বর পুরুষেরই হোক কিংবা কোনো নারীর, খুবই বিমোহিত হই। আনন্দে হৃৎপিণ্ড দুলতে থাকে। ভাবি এই তো লেখকের সার্থকতা, যা হোক আমি তো কোনো অবস্থাতেই লেখাটা খুব একটা পরিশ্রমের কাজ বলে মনে করি না। যদিও জানি লিখতে লিখতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এ অবস্থায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু নিঃশ্বাস বায়ু বইতে থাকে। এই নিঃশ্বাস বায়ুর সাথে জড়িত হয়ে আছে আমার জীবন। আজ মনে প্রশ্ন জাগে­ এমন একটা কাজ কেন বেছে নিলাম যার জন্য পুরস্কারও নেই, তিরস্কারও নেই। তবুও হঠাৎ যখন কোনো অজ্ঞাত স্থান থেকে কিংবা বলা যায় এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এই যে আমাদের পৃথিবী, এরই একটি গৃহকোণে হঠাৎ বেজে উঠেছে টেলিফোন; কী বার্তা, তা যখন জিজ্ঞেস করি তখন উত্তর আসে­ আপনি লিখে যান, শুধু লিখে যান। এ কথায় আমার অন্তরাত্মায় আনন্দের ফোয়ারা উচ্ছ্রিত হতে থাকে। ভাবি আমার লেখা পৌঁছে গেছে। আমি যেখানে যেতে পারিনি কোনো দিন, যেখানে ছিলাম না সেখানেও আমার কলমের কালি মাখা অগ্রভাগটি কাজ করা শুরু করেছে। আমার মন প্রফুল্লতায় একদম ভরে যেতে থাকে। আমি যাইনি; কিন্তু আমার আত্মার শক্তি বিশ্বব্যাপী আত্মীয়তা বৃদ্ধি করে চলেছে। এর চেয়ে বড় সার্থকতা কবির জন্য আর কী হতে পারে?
বই লিখেছি প্রচুর, এই বই কোনো আন্তর্জাতিক সীমা মানে না। তা ছাড়া বইয়ের কোনো দেশ-বিদেশ নেই। সে চলে যায় আপন মনে উড়াল দিয়ে বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা নিবৃত পাঠকের কাছে। বইয়ের এই শক্তি চিরকালীন। যখন লিখেছি তখন তা কেউ না কেউ পড়বেই। প্রতিক্রিয়া হয়তো জানব না, কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠা জগৎব্যাপী ঘুরে বেড়াবে। এটুকুই তো লেখকের সার্থকতা, আর যদি তিনি কবি হন তাহলে তার স্বপ্নের ভেতর থেকে স্বপ্ন জন্ম নেবে। এভাবেই তৈরি হয় প্রকৃত আত্মীয়তা, যা রক্তের সম্পর্ককেও তুচ্ছজ্ঞান করে অনাত্মীয়কে একান্ত আপন করে তোলে। এ জন্যই তো বেঁচে থাকা। কলমের কালি শুকায় না। কারণ জীবনের উৎসমুখ সিক্ত হয়ে আছে আমারই আত্মার রসে লাল হয়ে। আজ বলতে পারি, আমি তো কোথাও কোনো ফাঁক রেখে যাইনি; যে ফাঁক মিথ্যায় ভরাট করা হয়েছে। পরিশ্রম করেছি। আমার পরিশ্রমের মধ্যেই পরাক্রম প্রকাশ পেয়েছে। আর তা ঘাম হয়ে ঝরেছে। রক্ত হয়ে ঝরেছে। চোখের পানি গণ্ড ভাসিয়ে দিয়েছে। তবেই না কেউ না কেউ আমার জন্য দুই ফোঁটা অশ্রুপাত করেছে। জীবনের সার্থকতা কী তা খুঁজে পাইনি। তবে বাঁচার সার্থকতা কবির জন্য লিখে স্বপ্ন সৃষ্টি করায়, কেউ লেখকের প্রকৃত সুহৃদ হয় না। তবে অনাত্মীয়ের মধ্যেও মিত্র সৃষ্টি হয়। এভাবেই জগতে ভালোবাসার একটা অলিখিত নিয়ম সৃষ্টি হয়েছে। কেউ যখন বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি তখন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ধাতু যে ইস্পাত তা-ও নরম হয়ে যায়। এই একটি শব্দ দিয়ে সব কাঠিন্যকেই মানবজাতি নরম করে রেখেছে। এর চেয়ে অধিক সার্থকতা আর কী হতে পারে?
লেখকের বা একজন কবির সার্থকতা হলো সৃজন রীতির মধ্যে বসবাস করতে করতে তিনি একদিন অলৌকিকতার ছোঁয়া পান এবং নিজেকে চিনতে পেরে এমন অবস্থায় পৌঁছে যান যখন তার প্রতিটি বাক্যই তার জীবনের মহাকাব্য তৈরি করতে থাকে।
লেখার কাজটা সবার কাজ নয়, তা যদি হতো তাহলে তো কেরানিরাই জগতের শ্রেষ্ঠ লেখক হতেন। কবিকে অবশ্যই আলাদা মানুষ হিসেবে, স্বপ্নের সৃজনকর্তা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যে দেশে কবি জন্মায় না সেখানে প্রকৃতিও আক্ষেপের ধ্বনি তুলতে থাকে। সৌভাগ্য সেই দেশের যেখানে, যে মাটিতে একজন কবির জন্ম হয়েছে।

কবি আল মাহমুদ

Leave a comment