দশ দিগন্তে উড়ালঃ কবিতার দিগ্বিজয় কেউ রুখতে পারবে না


নি
জের চিন্তার জ্বরে জর্জর অবস্থায় কাল কাটাচ্ছি, আমার জন্য কোনো পুরস্কারও নেই, তিরস্কারও নেই। মানুষ ভাবে আমি কবি। আমি স্বপ্ন খেয়ে বেঁচে থাকি। অথচ আমার ক্ষুৎপিপাসা আছে। আমি স্বপ্নের কথা বললেও স্বপ্ন আমার খাদ্য নয়। আমি অবশ্য স্বপ্ন ভাঙিয়ে খুচরো পয়সার মতো নানা দুঃখ, অশ্রুজল ও অনুভূতি ক্রয় করে থাকি। আমার জন্য কারো কোনো দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হোক এটা চাই না। যদিও লেখাটাই আমার পেশা। অন্য জীবিকায় যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একটা কাজই শিখেছি। আর সেটা হলো লিখে যাওয়া। আমার লেখা কত দূর গিয়ে পৌঁছেছে তার আভাস মাঝে মধ্যে পাই। কিছু দিন আগে সাজ্জাদ বিপ্লব নামে একজন তরুণ কবি আমাকে জানালেন, আমার লেখা ঢাকায় প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তা পুনর্মুদ্রিত হয় এবং এভাবে ছড়িয়ে যায় বাংলা ভাষার অপেক্ষমাণ আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছে।

সবাই আমাকে লেখাটা চালিয়ে যেতে বলেন। অন্য দিকে রুটিনমাফিক কাজ করার শক্তি আমার অপেক্ষাকৃত কমে এসেছে। তা ছাড়া স্মৃতিনির্ভর লেখা আর কত দিন লেখা যায়? আমি বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে দেখেছি আমার লেখা নানাভাবে মানুষের আস্থাকে দৃঢ় করে। আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখক নই। যদিও আমি কবি। জাতির প্রতি আমার কর্তব্যনিষ্ঠা উপেক্ষা করতে পারি না। নির্জলা সত্যও বলতে পারি না, আবার মিথ্যাও বলতে পারি না। আমাকে অবস্থান নিতে হয় সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা আমার পছন্দনীয় না হলেও আমার ভক্তদের ধারণা, এটাই নাকি কবির জন্য যথার্থ স্থান। এতে আমি বিষণ্ন বোধ করি, বিব্রত হই। আমি তো আমার দেশের জনগণের জন্য লিখি। আমার দেশের মাটির পক্ষে দাঁড়াই। আমি স্বপ্ন দেখলে সেটা যেমন বলি, দুঃস্বপ্ন দেখলেও সেটা আগেভাগে আমার জাতিকে জানিয়ে দিতে চাই। সত্য কথা বলতে কী এ পর্যন্ত যা কিছু করেছি তা দেশ ও জাতির জন্যই করেছি। নিজের জন্য শুধু দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কোনো কিছুই নেই আমার কাছে।
কবিজীবনের সার্থকতা কী­ এর জবাব বহুবার দিয়েছি। বলেছি, কবির কাজ হলো মানুষকে আশায় উজ্জীবিত করা এবং স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলার অভ্যাস করা। আমার কথা শুনে কেউ প্রীতি বোধ করেনি। আবার আমাকে ত্যাগও করেনি।
আমি আছি আমার মতো। ভালোবাসা ভাঙিয়ে খাই। অথচ মানুষের ভালোবাসা ভাঙালে যে খুচরো পয়সা পাওয়া যায় তার নাম উষ্ণ অশ্রুজল। উচ্চৈঃস্বরে যারা কাঁদে তাদের কান্নার পরে বিশ্রাম জোটে, কিন্তু যারা নিঃশব্দে কাঁদে তাদের মুখ থেকে, চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে যায় উষ্ণ নির্ঝর। আমি সব ধরনের কান্নারই প্রতিনিধিত্ব করেছি কবিতায়। ফলে আমার ভাগ্যে জুটেছে একধরনের একাকিত্ব। যে নৈঃশব্দ মানুষ সহ্য করতে পারে না, আমি তা একটু একটু করে অভ্যাস করে নিয়েছি। এখন এমন একটা পরিস্থিতি, মানুষ আমার প্রায়ান্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি হাসিও না, কাঁদিও না। কোনো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি আর উচ্চারণ করি না। তবে লিখতে চাই, দেশের লেখা, শেষের লেখা। এই যে আমার সর্বশক্তি ব্যয় করে এই কলামটি আমি লিখে যাচ্ছি, এর জন্য কোনো প্রশংসা দাবি করি না। তবে পরিশ্রম যখন হয় তখন তার ভেতরে থাকে আমার প্রাপ্যের প্রশ্ন। আমি শেষ পর্যন্ত আমার পাওনাটা হয়তো পাবো। আমি জীবিত থাকতে পেলেই মঙ্গল। না পেলে আফসোস। দেশ-বিদেশে আমার এত শুভাকাঙ্ক্ষী আছে, তা আমার জানা ছিল না। এখন বুঝতে পারছি লেখালেখির একটা সীমা আছে। ওই সীমার মধ্যেই যেটুকু প্রকাশ করা যায় তা বলেছি। কিন্তু কী যেন বলা হয়নি। হয়তোবা আমার অদৃষ্টে কোনো শুভ বা অশুভ ঘটনা বা দুর্ঘটনা আমার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। লিখতে লিখতে ভয় বেড়ে যাচ্ছে। ভাবি, কোনো কিছু ঘটলে আমার সহ্যের ক্ষমতা কতটুকু, তবু আমি সর্বদা দুর্ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এর মধ্যে সৌভাগ্যও এসে আমাকে ইশারা করে। কেবল ইশারা। দেয় না কিছুই। নিয়ে যায় কবির দীর্ঘশ্বাস। এটা ঠিক নয়, আমি সর্বাবস্থায় অকাতর, অচঞ্চল থাকতে পারি। না, পারি না। ভেতরটা বাসন ভাঙার শব্দের মতো মাঝে মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি ভয় পাই কিন্তু পালানোর কোনো জায়গা নেই। আমি কবিতায় কাজ করতে এসেছিলাম। আমার বিশ্বাস আমি তা ঠিকমতোই করেছি। কিছু মানুষকে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি তা রাখতে পারিনি। কোনো কবিই রাখতে পারে না। অথচ এখন সেটাকেই খুব বড় করে তোলা হচ্ছে। যা হোক, জীবন এক সমাধানহীন সত্য ঘটনা। এই জীবন আমি প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন আমার ব্যাপারে অভিযোগ থাকলেও শাস্তি নেয়ার যোগ্য নই। আমার কাঁধ বড় দুর্বল। এর ওপর সব সমস্যা চাপিয়ে দিলে প্রতিবাদ করতে পারব না বটে, তবে বোঝা বইতেও পারব না। কতবার বলেছি, আমার কবি ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। সব কবিরই অন্তিমে কিছু পারিশ্রমিক জোটে। আমারও হয়তো জুটবে। কিন্তু সেটা এখনো কেউ আমাকে হাতে তুলে দেয়নি।
এর মধ্যে সম্প্রতি বেরোনো আমার দুটো কবিতার বই স্পর্শ করে দেখার সুযোগ পেয়েছি। একটি দীর্ঘ কবিতার বই। অন্যটি কিছু ক্ষুদ্র কবিতার সমষ্টি। ভালো লাগছে আমার সৃজনক্ষমতা এখনো একবারে লোপ পায়নি।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কার কী অবদান তা ভালো করে জানি না। তবে আমার কিছু কাজ আছে যা অগ্রাহ্য হয়নি। এতেই আমি খুশি। কবিজীবনের সার্থকতা হলো প্রকাশে। আমিও প্রকাশ করেছি। বাজারের হট্টগোলে এখন সবারই উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দিন পরই হয়তো এই উন্মাদনা থিতিয়ে আসবে। তখন দেখা যাবে কার কতটুকু অমৃত রস জোগান দেয়া সম্ভব হয়েছে।
গায়ের জোরে কিছু হয় না। সাহিত্যে জোরজবরদস্তি চলে বটে কিন্তু টেকে না। একটি ভালো কবিতা চিরকালই প্রশংসার যোগ্য। কালি ছিটিয়ে কারো অবদানকে অবমূল্যায়ন করা ঠিক নয়। আমি তো বহুবার বলেছি, আমাদের অনেক কবির দরকার। ভাষার স্বার্থে নানা ধরনের তরুণ কবি নর-নারীর আগমনকে স্বাগত জানাতে হবে। আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো আমাদের ভাষা। অর্থাৎ আমাদের কবিতা। এ ক্ষেত্রে অনেক অবিচার-অনাচার হলেও সগৌরবে এখনো মাথা তুলে আছে। একে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সহায়তা দিতে হবে। তবেই আধুনিক বাংলা কবিতার পরাক্রম প্রকাশ পাবে। কবিতা নিয়ে তথা সাহিত্য নিয়ে আপসরফা চলে না, যে প্রকৃত কবি তাকে মঞ্চে তুলে আনতে হবে। আবৃত্তি করতে দিতে হবে তার কবিতাকে এবং একই সাথে ঘোষণা করতে হবে, কবিতার দিগ্বিজয় কেউ রুখতে পারবে না।
এভাবেই বাংলা কবিতার পুনরুজ্জীবন ঘটবে। ছড়া ছাড়া কেউ কিছু লিখতে পারছে না এটা কেমন কথা? কবিতা কেন ছড়াকে মাঠ ছেড়ে দিয়েছে এটা বুঝতে হবে। এটা ছড়ার যুগ, কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার তাহলে গতি কী হবে? যদি বলা হয় কবিতা না হলেও চলে, তাহলে আমি অবশ্যই এর প্রতিবাদ করব। ছড়ার ছরছরানি চলুক। আমার এতে আপত্তি নেই। আমিও ছড়া লিখি। কিন্তু কবিতার কাজ কবিতা করতে পারলে আমার আর কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে কবিতার বদলে ছড়া, এটা কোনো কাজের কথা নয়। এটা হলো আমাদের ভাষার একধরনের অবক্ষয়ের লক্ষণ।
আমার কথায় ছড়াকারদের দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আমি নিজেও তো একজন ছড়াকারই বটে। কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার সমকক্ষ হিসেবে ছড়াকে কবিতার বদলে জাগিয়ে রাখার পক্ষপাতী নই। ছড়ার কাজ ছড়া করবে, কিন্তু আধুনিক বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য আধুনিক বাংলা কবিতাতেই প্রকটিত হয়েছে বেশি। এই সত্য অস্বীকার করলে ছড়াকারদের কোনো লাভ হবে না। দুটো পদ্ধতিকেই আমরা জাগিয়ে রেখে মহাকালের দিকে যাত্রা করতে চাই।

কবি আল মাহমুদ

Leave a comment