দশ দিগন্তে উড়ালঃ পালানোর সুযোগ নেই পালাব কোথায়


মা
ঝে মধ্যে মনে হয় আমি যেন স্মৃতিভ্রষ্টতার রোগে ভুগছি। হঠাৎ কোনো কিছু মনে রাখতে পারি না। আবার কখনো মনে হয়, না, কই আমি তো চোখ বন্ধ করে ভাবলে অনেক দূর পর্যন্ত পেছনের দিকটা দেখতে পাই। শুধু ভবিষ্যৎ দৃষ্টিটাই আমার বেশি দূর এগোতে পারে না। কেমন যেন একটা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবুও সাধ্যমতো এই কলামটি লিখে যাওয়ার চেষ্টা করব।

অনেক দিন ধরে তো লিখেই চলেছি, আরম্ভ বা শেষ কোথায়; এখন তা চিন্তা করে দেখতে হচ্ছে। একবার বলেছিলাম, লিখতে হলে দেখতে হয়। যদিও আমার দৃষ্টি একেবারে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তবুও লেখার বাসনাটাকে জিইয়ে রাখতে হলে যত দূর সম্ভব হেঁটে বেরিয়ে দেখতে চাই। কবি হিসেবে আমার কল্পনা শক্তির সীমানা অনেক বড়। এর মধ্যে ধরে যায় আমার অতীত শৈশবকাল এবং আত্মীয়-পরিজনের মুখ। আমি চোখ বন্ধ করলে কল্পনার তরঙ্গের ওপরে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ভাসতে থাকে। মনে হয়, আমার মধ্যে এক কৌতূহলী শিশু নানা পুতুল নিয়ে খেলছে। এই সবগুলো পুতুলই যে আমার এক সময়কার পরিচিত জন ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদের আর কল্পনা ছাড়া সাক্ষাৎ পাই না। হয়তো কেউ জীবিত আছেন, কেউ নেই। কিন্তু আমি তো আছি। কিভাবে আছি, কে জানে, মনে হয়, অনেক কিছু ভুলে গেছি বলেই আমার বাঁচতে সুবিধা হচ্ছে। যাদের ভুলে গেছি, তারা কিন্তু আমাকে ভুলে যাননি। সেটা টের পাই। কেউ আমার সাথে আজকাল আর দেখা করতে আসেন না বটে; কিন্তু আমি বুঝতে পারি, অমুক অমুক মানুষ; মানুষের মুখ এখনো বিচরণশীল, দুয়েকজন স্থবির হয়েছেন সত্য। কিন্তু আমার বাঁচার পরিধির মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা বহালতবিয়তেই আছেন। আমি তাদের জন্য হৃদয়ে ভালোবাসাই পোষণ করি। মানুষ সব কাজ গুছিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রেখে যেতে পারে না। মানুষ মাত্রই খানিকটা এলোমেলো সত্তা, কিছু পারেন, কিছু পারেন না। আমিও আমার কাহিনী, আমার কাব্য ইত্যাদি কিছু পেরেছি, কিছু পারিনি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, যাদের কিছুতেই শত্রু করে তুলতে চাইনি তারা আমার সাথে সহজ আচরণ করেননি। যৌবনকালে আমাকে অনেকেই আমার বিশ্বাসের কারণে কোণঠাসা করে রাখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে কোণঠাসা অবস্থায় থাকিনি, আমার কবিতা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বারে বারে গর্তে পড়ে গেলেও আমার কবিতাই আমাকে আলোতে নিয়ে এসেছে। আমার কাব্যের কাছে ঋণ স্বীকার করি।

আমার যারা শত্রুতা করেছেন, তারা অনেকেই আমার কবিতাকে বিচার না করেই আমাকে আঘাত করতে পেরেছেন। আমি ব্যক্তি হিসেবে বলবান নই। ক্ষীণ স্বাস্থ্য, দুর্বল শরীর নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে আছি। কারো ওপর নির্ভরশীলতা আমার ছিল না, একমাত্র আমার প্রভু ছাড়া। শুধু লিখেছি, এই লেখাই আমাকে অভাবনীয় দুর্যোগ-দুর্গতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে, তা ছাড়া পারিবারিক অনেক শিক্ষাই আমি গ্রহণ করতে না চাইলেও তা আমার মধ্যে সতেজ ছিল। উপেক্ষা করতে জানি, অপেক্ষাও করতে শিখেছিলাম। আজ যা পাইনি, তা এক বছর পরে পাবো­ এই মনোবৃত্তি আমাকে আশার মধ্যে বেঁচে থাকার কায়দাটা শিখিয়েছে। অনেক দিন আগে আমার মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল। আর সেটা হলো আধুনিক মানুষের কোনো বন্ধু হয় না। মুখেও এই কথা বলতাম, কিন্তু আজ এত দিন পর মনে হচ্ছে, বন্ধু ছাড়া কল্পনাপ্রবণ কবির কোনো আশ্রয় থাকে না। আজ যদিও এসব কথাকে আর মেলাতে পারি না, তবুও তো আমি বেঁচে থাকি। কোন সুখে বেঁচে থাকি? বাঁচাটা কি কোনো নেশার মতো ঘটনা? নাকি, অন্যতর কোনো আবেগের তাড়না? এখনো তা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছি না।

সৃজনশীলতা সব মানুষের মধ্যে সম্ভব হয় না, অথচ যারা সৃজনশীল মানুষ, তারা অন্যের সাহায্য ছাড়া জগতে বসত করতে পারে না। বর্তমানে রোগ-শোক ও স্থবিরতা অতিক্রম করে কোথাও পৌঁছাতে পারছি না, আমার দুর্দশাটা লিখে বর্ণনা করার মতো নয়। এসব বর্ণনা করার আলাদা ভাষা আছে, একদা আমারও ছিল। কিন্তু বহু দিন চর্চা না থাকায় আমি সে ভাষা এখন আর ব্যবহার করতে পারছি না। যা হোক, এসব কথা কোনো কবি লিখে জানাতে চান না।

শুধু বলতে পারি নানা দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক ও নিরুপায় অবস্থার মধ্যে আমাকে লিখে যেতে হচ্ছে। কোনো অভিযোগ বা নালিশ উত্থাপন করি না। তেমন বড় কিছু আশা করি না নিজের জন্য। ফলে হতাশাও আমাকে গ্রাস করতে পারে না। আশা নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছি। টিলা-টক্কর অতিক্রম করে কোথাও পৌঁছতে চাই। জানি না, পৌঁছার জায়গাটা আমার জন্য আরামদায়ক হবে কি না। কষ্টকর হলেও আমার আপত্তি নেই। কেবল পৌঁছতে চাই একেবারে শেষে। একেবারে প্রান্তসীমায়। এখন আর কোনো গালমন্দের দিকে কর্ণপাত করি না। আমার কথা হলো আরম্ভ করেছিলাম কোথাও পৌঁছব বলে। এখন সেই পৌঁছানোর জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি। অনেক মানুষ এখানে আছে, অনেক নারী-পুরুষ; কিন্তু কেবল আমার মধ্যেই একধরনের বাড়ি ফেরার আবেগ। জানি না, আমার বাড়ি কোথায়। সেখানে কে আছে, কারা আছে। তারা কি আমার আপনজনই? যদি কেউ আপনজন হয়ে থাকে, তাহলে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিক আমার বিশ্রামের জায়গাটা কোথায়? কেউ এগিয়ে আসছে না। আমাকে চেনে এমন কোনো মানুষ এখানে আছে কি? অথচ সবাই তো আমাকে দেখছে। প্রবল কৌতূহল নিয়ে দেখছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে বলছে না, এখানে একটু বসুন। কোনো আমন্ত্রণের তোয়াক্কা করি না। শুধু শেষটা দেখতে চাই। আমার শেষ কোথায়? একই সাথে আমার দেশ কোথায়? আমার মায়ের কথা এ মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। কতই না দয়ালু ও স্নেহার্দ্র বাহুতে আমাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। আমি অবাধ্য সন্তান তার বাহু সরিয়ে সড়কে এসে উঠেছিলাম। তার পরের কাহিনী শুধুই অনুতাপময়। আজ সেই মায়ের কথা, তার মুখখানি চোখে ভাসছে। চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছে আমার সব অতীত ও ভবিষ্যৎ। আমার গন্তব্য কোথায়, তা যদি যাত্রার সময় কেউ আমাকে ইশারায়ও জানাত তাহলে এই সড়কে আর নিরুদ্দেশের দিকে হাঁটা শুরু করতাম না। এখন তো স্বীকার না করে পারছি না, আমি বড়ই ক্লান্ত-শ্রান্ত, আমার বিশ্রাম দরকার। অন্তিমের ঘরে আশ্রয় দরকার। আমার জন্য কে শয্যা রচনা করে দেবে? কে ভালো-মন্দ কুশল ইত্যাদি জিজ্ঞেস করবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো ধোঁয়া উড়া এক বাসন গরম ভাত কে এগিয়ে দিয়ে বলবে­ ‘নে, খা।’ আমি এতই ক্ষুধার্ত যে, সব কিছুকে খাদ্য মনে হচ্ছে। আমি বলব, পার হয়ে এসেছি। কী কী পার হলাম, এসব জিজ্ঞাসা করার কেউ আছে কি? না থাকলে খতিয়ান খোলার প্রয়োজন কী? সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি পার হয়ে এসেছি। আমার সাথে যারা যাত্রা শুরু করেছিল, তাদের অনেকে পথেই পরিশ্রান্ত হয়ে ঢলে পড়েছে, কেবল আমিই এসেছি। একজন হতভাগ্য মানুষ। একজন কবি, আর কিছু নয়। কবিত্বের কোনো কৈফিয়ত হয় না। অপরাধের দণ্ড হয়। আমার কোনো দোষ-ঘাট হয়েছিল কি না; আমার বিরুদ্ধে নালিশ যখন নেই, তখন আমার নির্দোষিতা প্রমাণিত না হলেও বাস্তব সত্য। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো আমি তো সবটুকু পার হয়ে এসেছি। যেখানে এসে দাঁড়াবার কথা, আমি তো এখন সেখানে। নালিশ যখন নেই, তখন আমি কি অভিযুক্তদের দল ছাড়া একাকী এখানে বসে পড়তে কিংবা শুয়ে পড়তে পারি না? আমার একটি শয্যা দরকার, বিশ্রাম দরকার, বিরাম দরকার।
এরপর যা কিছু আছে এসব নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আসুক পর্যায়ক্রমে। একের পর এক। আমার তো পালানোর কোনো সুযোগ নেই, পালাব কোথায়?

কবি আল মাহমুদ

Leave a comment