দশ দিগন্তে উড়ালঃ শেষহীন অশেষের উপাখ্যান


দুঃ
খ, দারিদ্র্য এবং শারীরিক অক্ষমতাজনিত স্থবিরতার মধ্যেও দিন তো আর বসে থাকে না। আমাদেরও দিন কেটে যাচ্ছে, হা-হুতাশ করার কোনো সুযোগ নেই। আর আমরা সেটা করিও না। আমার কর্তব্য হলো, যেকোনো অবস্থাতেই হোক লিখে দিন গুজরান করা। যেহেতু কোনো রাজনৈতিক পক্ষের ধার ধারি না­ অর্থাৎ রাজনীতি আমার বিষয় নয়, সে কারণে আমার বিবেক অনুযায়ী লিখে চলেছি। কাউকে ঘাঁটানো কিংবা হঠানো আমার বিষয় নয়। তবে বাংলাদেশের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করলে এমন বিষয় এসে যায় যাতে কলম দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে; বেশি দূর এগোনো যায় না। সাধ্যমতো নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে যতটুকু পারি, লিখে চলেছি। বয়সের কারণে প্রতিবন্ধীর মতো ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। কোথাও যে একটু বেরিয়ে আসব, তারও কোনো সুযোগ নেই। কেউ আমার বাইরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেন না। অবশ্য আমার ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বহির্গমন বাদ দিয়েই চলেছি। মাঝে মধ্যে অবশ্য কেউ আমার প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন করতে গিয়ে আমাকে হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার জন্য নিয়ে যান বটে; সেটাও বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। কাছেই ঘুরেফিরে ঘরে ফিরে আসি। এতেই আমার আনন্দের সীমা থাকে না। লেখার যে সতেজতা ও প্রাণশক্তি দরকার, এতেই মোটামুটিভাবে নিঃশ্বাস টেনে বেঁচে থাকি। আর চিন্তা করি, আমার মতো বৃদ্ধ আর কী কী সুযোগ ব্যবহার করলে সতেজ থাকা যায়। শেষ পর্যন্ত লেখাই আমার নিয়তি। যদি লিখে কোথাও পৌঁছানো যায়, তাহলে সেটাই আমার জন্য উত্তম হবে ভাবি। মাঝে মধ্যে ছেদ টেনে হাত গুটিয়ে বসে থেকেও দেখেছি, আমার কোনো আরাম হয় না।

লিখতে চাই এমন ঘটনা, যা ভবিষ্যতে ঘটবে। অথচ ভবিষ্যৎ এক হাত আগেও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আমাকে থামিয়ে দেয়। ভাবি, আমি তো ভবিষ্যদ্বক্তা নই। অতীত নিয়েই আমার অনেক স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। অথচ অতীতচারী মানুষও হতে রাজি নই। অতীতও নয়, ভবিষ্যৎও নয়; বর্তমানই হলো নগদ কিছু উপস্থাপনের বিষয়বস্তু। বর্তমানের ওপর শক্তভাবে দাঁড়াতে চাই, কিন্তু বর্তমানের দাঁড়ানোর জায়গাটা এমনভাবে কম্পমান যে, মনে হয় যেন ভূমিকম্প এসে ধাক্কা মারছে। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। হাত দিয়ে দেখি, বাংলাদেশের মাটি। এই তো বর্তমান; আমার মতো নিরাশ্রয় মানুষের উপকূল ভূমি। একেই জাপটে ধরে বাঁচতে হবে। দুঃখ-কষ্ট যা-ই হোক, এটাই আমার বাঁচার উপকূল। লেখক হিসেবে আমার সার্থকতা কোথায়, তা কেন জানতে চাইব না? অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে একদিন আমার উত্থান হয়েছিল। কবি হিসেবে, স্বাপ্নিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি বলে মনে হয়। অথচ আমার হাত শূন্য। শূন্য কেন­ এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আমি যা লিখেছি কবিতা হোক গদ্য হোক, আন্তরিকতা নিয়েই তা রচিত হয়েছে। কালের পৃষ্ঠায় আমার কলমের দাগ অস্বীকার করা যাবে না। কারণ সৃজনরীতির যে রোমাঞ্চিত অবস্থা, তা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম। মানুষ আমার লেখা পড়ে কেঁপেছে, কেঁদেছে। এখন যদি প্রতিদান পেলাম না বলে অপেক্ষা করি, তাহলে সেটা গ্রাহ্য হবে না।

আমি যা চেয়েছিলাম বা আমার পক্ষে যা সম্ভব ছিল, তা তো করেছি। এর বেশি একজন কবি আর কী করতে পারে? তবে আক্ষেপ আমারও আছে। সেটা হলো, এত সব লেখার পরিশ্রমের মধ্যে আমার জন্য, একজন বন্ধু বা বান্ধবী গড়ে তুলতে পারিনি। এই না পারার ব্যর্থতা আমার একার। এ জন্য কাউকে দোষারোপ করা যায় না। যৌবনে অনেক দুঃসাহসিক লেখা আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। অথচ উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়নি বলে তা স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে। জানি না, কখন কালের বিচার আমার প্রতি প্রসন্ন হবে।

তবুও তো কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে হার মানিনি। বলি না, আমি জিতেছি; কিন্তু আমি তো পরাজিতও হইনি। বারবার ঘোষণা করেছি, কবিরা পরাজিত হয় না। নিয়তি আমাকে বারবার এ দেশের কাদামাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি করেছে। মুমূর্ষু হয়েছি, কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলেই ঘোষণা করেছি আমি আছি; আমি বেঁচে আছি। এই যে লড়াই, এর কোনো বিরতি নেই। তবে ক্লান্তি আছে। বিশ্রামেরও সুযোগ দেয়া হয় বটে; কিন্তু যুদ্ধের কোনো ইতি নেই। কেউ ঘোষণা করে না, লড়াইটা শেষ হয়েছে।
এ অবস্থায় কবির কর্তব্য যে, জাতিকে স্বপ্ন দেখানো, সেটা কি আমি করিনি? পুরস্কার না হোক অন্তত তিরস্কার তো আমার জন্য তোলা থাকার কথা। এ কেমন পরিশ্রম যে, পুরস্কারও নেই, তিরস্কার নেই? অথচ একটা জীবন চলে গেছে আমার; আস্ত একটা জীবন। কে ফিরিয়ে দেবে আমার জীবনের যৌবন-কৈশোরের দিনগুলো? চাইনি বলে কি আমাকে দেয়া হবে না? তাহলে আমার বক্তব্য হলো, বঞ্চিতদের হাহাকারের মধ্যে আমার ইতিহাস কেউ প্রচ্ছন্ন রাখতে পারবে না। আমার ইতিহাস তো কোনো অলিখিত সাদা কাগজ নয়। কলমের কালিতে কালিমা লিপ্ত হলেও একটি আস্ত জীবন। দাও, ফিরিয়ে দাও আমার জীবন। যদি না পারো তাহলে চুপ করে থাকো। আর একটি শব্দও নয়। আমিও অপেক্ষা করি; তোমরাও করো। দেখি অপেক্ষা শেষে­ কী আছে আমার অদৃষ্টে।

কই, আমি তো কোনো ফাঁকি দিইনি। কাউকে প্রবঞ্চিত করিনি। যদি কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে থাকি, সেটা আমার অক্ষমতা। সাধ্যে কুলায়নি বলে কথা ভেঙেছি। কথা ভেঙে আমি কি সুখী? আমি কি কাঁদিনি? তবে আমার কান্নায় অশ্রু ঝরে না। সিক্ত হয় না গণ্ডদেশ। শুধু চোখের মণি তিরতিরিয়ে কাঁপে। এই কান্না সহ্য করতে পারে না কোনো মানব-মানবী। ইতিহাসের তাকে বইয়ের ফাঁকে তা জমা হয়ে থাকে। কেউ কি আছে হিসাব মেলানোর।

আমি লিখতে এসেছিলাম। আমার সাধ্যমতো তা লিখে গেলাম। বইয়ের পৃষ্ঠায়, মানুষের হৃদয়ে, জীবনের নানা উপকূলে সে কাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে। কেউ পড়তে জানলে পড়বে, না পড়লেও আমার তো কোনো ক্ষতি নেই। আমি বঞ্চিতদের দলে বাসা বেঁধেছি। সেখানে আশার বীজ বপন করেছি। এখন আমার তো আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সব বিদায়ের মুহূর্তই দুঃখের। আমি তো আর হাসতে হাসতে ইতিহাসের হাত ছেড়ে দিতে পারি না। তবে আমার প্রতিশ্রুতি এই যে, আমি কাঁদব না, কোনো বিলাপ বা রোদনধ্বনি উত্থিত হবে না আমার যাওয়ার মুহূর্তে। আমি কবি ছিলাম, কবির জন্য কেউ কাঁদে না। হতে পারে কেউ গালমন্দও করে না। কেবল এক নৈঃশব্দ এসে সব কিছু কুয়াশার মতো ঢেকে দেয়। কুয়াশাচ্ছন্ন আমার সেই মুখখানি কে দেখতে চায়? কেউ কি আছে?

সব মানুষই শুরু করে শেষ করবে বলে। কিন্তু দুয়েকজন হতভাগ্য থাকে যারা শেষ করতে পারে না। কী হয়, যদি শেষ না হয়? আসলে এই শেষহীন অশেষের কাহিনী মানুষ এত পড়তে চায় কেন, তা নিজেও জানি না। তা ছাড়া মানুষ এক রহস্যময় প্রাণী। এখনো তার সবটা ঠিকমতো জানা যায়নি। অন্তত লিখিত কোনো বিবরণে নেই। মানুষের কাহিনীর যখন মানুষই রচয়িতা হয়, তখনই শুরু হয় আলো-আঁধারির খেলা। চোখের জলে নিজের লেখাই লেখক আর দেখতে পায় না। ঝাপসা হয়ে আসে সব কিছু; কিংবা বলা যায় মিথ্যাও তখন সত্য বলে ভ্রম হতে থাকে। তবে লেখা তো থেমে থাকে না। পঙ্ক্তির পর পঙ্তি সৃজনরীতির সব অলঙ্কার নিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। এ জন্যই কবিরা বলেন, মানুষের ইতিহাস মানুষের কলমে লিখিত হওয়া মুশকিল হলেও সেটাই উচিত। এ পর্যন্ত জগতে যত করুণ কাহিনী মানুষকে অশ্রুসজল করেছে, এর সবটাই মানুষেরই হাতে রচিত মানুষের কাহিনী মাত্র। এর কোনো শেষ নেই। আসলে শুরুও নেই; যদিও কোনো না কোনোভাবে কেউ না কেউ কোনো জায়গা থেকে এর আরম্ভটা সূচনা করে।

কবি আল মাহমুদ

Leave a comment