সত্যের সততা


হুদিন ধরে এই শহরের বাসিন্দা আমি। থাকি মোটামুটি ভদ্রোচিত অবস্হায়। এখন যদিও শারীরিক কারণে একটু স্হবিরতায় আক্রান্ত। কিন্তু লেখালেখির উদ্দীপনায় একেবারে অচল হয়ে পড়িনি। সব সময় কেমন একটা চিন্তা হয়-বাড়ি চলে যাই।

এই চিন্তায় এক ধরনের স্বস্তি আছে। কিন্তু শান্তি নেই। কারণ আসলে আমি বাড়ি যাব কেন? আমরা তো এখানেই সব। পরিবার-পরিজন, অসুস্হ স্ত্রী এবং আমার অন্ন সংস্হানের জন্য লেখালেখির সুযোগ। সবই এখানে। তাহলে আমি বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবি কেন? তবে কি আমি মৃত্যুর কথাই ভাবি? আর মৃত্যুচিন্তা থাকবে না কেন? আমার তো বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ হয়েছি। চোখ দুটি প্রায়ান্ধ।

মনে হয় এর ভেতরে কিছু একটা আছে। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি, এর মধ্যে সহজে কিছু খুঁজে না পেলেও মন বলছে, আছে। আছে তোমার সৃজন ক্ষমতা। এটা তোমাকে একদিকে যেমন বাঁচতে সাহায্য করে, অন্যদিকে মরণের আরশি তোমায় মুখের ওপর ধরে থাকে। বলে “দেখ, দেখ”।


আমি তাকিয়ে থাকি আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। মনে হয়, আমার যা কর্তব্য ছিল, তা তো আমি করেছি। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মালে মানুষের কিছু নিজস্ব রীতি আছে। এই রীতির মধ্যে থাকতে হয়। আমি কবি বলে মাঝে মাঝে যন্ত্রণাকাতর হয়ে এই রীতি মানি না। ফলে দুর্ভাগ্য আমাকে ছলনা করে কখনো আপনজন সেজে, হাতছানি দিয়ে অসম্ভবের অন্তরালে ডাকতে ডাকতে নিয়ে গেছে। আমাকে বুকে চেপে ধরেছে। আমার মুখে ঢেলে দিয়েছে গরল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, আমি নিরুপায় হয়ে ঢক ঢক করে পান করেছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে কে যেন বলেছে, “খাও, খাও”। আমি বলেছি, কী খাদ্য আমার মুখে ঢেলে দিলে? অন্তরাল থেকে ফিস ফিস করে বলা হলো, তুমি খাচ্ছ তোমায় হায়াত। আরও খাবে?

আমি মুখ সরিয়ে নিলাম। বললাম, সমগ্র আয়ুষ্কাল একবারে আমার মুখে ঢেলে দিলে আমি কী করে খাব! আমি বাঁচার জন্য হাহুতাশ করছি না, কিন্তু মৃত্যু কি সেটা তো আমাকে বুঝতে দেবে। এতে মুহুর্তের মধ্যে স্তব্ধতা নেমে এলো। বুঝলাম যে কেউ নেই।
তবু যতটা পারি নিঃশ্বাসের শব্দের মতো বললাম, তুমি কি নিয়তি?

এতটাই জান? হ্যাঁ, আমি সেই। লোকে আমাকে এ নামেই ডাকে। তাহলে তুমি আর কোনোদিন মৃত্যুকে জানতে চাইবে না। ভয় পাবে না। কারণ, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি কখনো কোনো অবস্হাতেই একা নও। আমি নিরুপায় হাসি হেসে মুখ ফসকে বলে ফেললাম, আমি তো কবি ছিলাম। কল্পনা করতে জানতাম। স্বপ্ন দেখতাম এবং সবাইকে দেখাতাম। তুমি যদি কেবল আমাকে ভয় দেখাও, তাহলে আমি আমার কবিত্বকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করব। এ পথে আমার কোনো সহায্যকারী চাই না। একাকিত্ব কবির নিজস্ব প্রতিভা।

একথায় বিতন্ডাকারিণী একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। আমার নিঃশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। এ অবস্হায় আমি তো থমকে না দাঁড়িয়ে পারি না। এখন যেখানে আছি, সেটাই সেই স্তব্ধতা। সব কবিকেই একদিন এ অবস্হা অতিক্রম করতে হয়েছে। আমাকেও এর মধ্যে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি যদিও কাঁপছি, হাত-পা থর থর করে কাঁপছে; কিন্তু আমি তো শুন্যে দাঁড়িয়ে নেই। কোনো শুন্যতা উপভোগ করছি না। ভাবছি না, কেউ নেই। অবস্হাটা যদিও আমার জন্য সহনীয় নয়। কিন্তু এমন অবস্হায় তো আমাকে মাঝে মধ্যেই পড়তে হয়েছে।

সৃজনের দোহাই দিয়ে কেউ এ অবস্হা থেকে রেহাই পায় না। অথচ কেউ যদি প্রশ্ন করে, তুমি যা কিছু গড়েছ, তা তো আসলে একজন নারীরই আকৃতি-প্রকৃতি প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত তোমার গন্তব্য কি কোনো ছলনাময়ী-মায়াবিনী নারীরূপ? আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, না, কখনো নয়। নারী তো একজন মা-ও হতে পারে। বোনও হতে পারে। দয়িতা হতে পারে। শুধু বিকৃতিটাই বিকশিত করতে এত চেষ্টা কেন?

কোনো জিনিসই প্রকৃত স্বরুপে পরিচ্ছন্ন হয়ে ধরা দিতে চায় না। কবিকে চিনে নিতে হয়। কবির চেনার শর্তগুলো হলো, যা সত্য তা কল্পনাতেও সত্যরুপে ধরা দেবে। আর যা মিথ্যা তা কল্পনাতেও মিথ্যা রুপে ছায়া ফেলবে। মিথ্যা মোহনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু কারো কোনো কাজে লাগে না। মিথ্যা মিথ্যাতেই মিলিয়ে যায়। তবে অনেক সময় নির্মম সত্য থেকে নিরুপম মিথ্যা মানুষকে স্বস্তি দান করে। মানুষ হতাশ হলে মিথ্যা সেখানে তাকে ছায়া দিতে আসে। কিন্তু মিথ্যার কোনো অনুতাপ থাকে না। সে অনুতাপে দগ্ধ হয় না এবং একই সঙ্গে মিথ্যার ছায়া আছে কিন্তু নড়াচড়া নেই। সত্য সব সময় ধাবমান। সে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে তার কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে দেয়। ডাক দিয়ে বলে, সাবধান। সতর্ক করাই হলো সত্যের নিয়ম। যারা এ নিয়ম মানেনি তারা একদিন কপাল হাতড়ে শুধু ললাট রেখাই পায়। ললাটের ভাঁজে যে পরিশ্রম আছে, যে মানব জীবনের সার্থকতা আছে তার সুফল ভোগ করতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, ঘামের স্বাদ বড়ই নোনা।

লেখকঃ কবি ও কথা শিল্পী
— আল মাহমুদ
(সূত্র, দৈনিক আমার দেশ, ০৯/০৬/২০০৯)

Leave a comment