সে আগুন জ্বলে যায় দহে না কোন কিছু


মা
নুষ সব সময় এক অপেক্ষমাণ প্রাণী। কার অপেক্ষা? এটা সঠিক করে এ মুহুর্তে লেখা যায় না। অপেক্ষা করে, এটাই সত্য। অপেক্ষা ছাড়া মানুষের দিন গুজরান করা এক অসম্ভব ব্যাপার। অপেক্ষা করে কেউ আসবে বলে। অপেক্ষা করে কারো হাসির জন্য। অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত হয়তো মৃত্যুর জন্যও।

এই যে আমার মতো বার্ধক্যপীড়িত এক বিষণ্ন আত্মা। আমি অপেক্ষা করি বৈকি। কার অপেক্ষা? সেটা যে অপেক্ষা করে সে সঠিকভাবে বলতে পারে না। বলতে গেলে বুকে যন্ত্রণা হয়। মুখ থেকে শব্দ নিঃসৃত হতে চায় না।

হ্যাঁ, আমি বসে আছি। পদশব্দও শুনতে পাই আমি। কিন্তু কার জন্য অপেক্ষা, সেটা বিশ্লেষণ করা কবির কাজ নয়। বরং অপেক্ষা সবসময় কেবল তিক্ত ফলই প্রসব করে, এমন নয়। অমৃতও অপেক্ষায় মিশ্রিত হতে থাকে।

অপেক্ষায় না থাকলে সকাল-সন্ধ্যা আমার মাথার ওপর দিয়ে পার হতে পারে না। যা কিছু পেয়েছি জীবনের সঞ্চয় তা তিক্ত হোক কিংবা মধুরই হোক, সবটাই অপেক্ষার চোয়ানো অমৃত রস। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে। আমার মাথার ওপর। বসন ভিজছে না। সিক্ত হচ্ছে না কিছুই। অথচ তিক্ত রস আমার গন্ড বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।

তিক্ত বললাম, এর কারণ জীবন সঞ্জীবনীর স্বাদ আমি এ পর্যন্ত তেঁতোই পেয়েছি। কেউ হয়তো এর অন্যবিধ স্বাদ আস্বাদন করে বলতে পারেন, না তেঁতো নয়। ঈষৎ নোনা। যা হোক, এ নিয়ে বিতন্ডা চলে না।

কবি হিসেবে একটি ভালো সমিল কবিতার জন্য অপেক্ষায় থেকে সফলতায় পৌঁছতে পারলে যে আনন্দ হয়, তার কোনো তুলনা নেই। কিন্তু জীবনটা কবিতার মতো নয়। তাছাড়া মানুষ পদ্য ইত্যাদির জন্য তেমন কাঙালও নয়। মানুষ অপেক্ষা করে কেবল একজন মানবীর জন্য। খোলাখুলি বললে যুবা হোক, বৃদ্ধ হোক কিংবা বয়োসন্ধির কিশোরই হোক, এই অপেক্ষার উন্মাদনা কিংবা বলা যায় উত্তেজনা থেকে মুক্ত নয়।

কল্প জগতে পুরুষ অপেক্ষা করে নারীর জন্য। কিন্তু নারী নিরপেক্ষ। সে অপেক্ষা করে না পুরুষের জন্য। সে অপেক্ষা করে কেবল সুদিনের জন্য। আরো স্পষ্ট করে বললে, ধনদৌলত, টাকা-পয়সা ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করে একটি মেয়ে। তাকে বিশ্বাস করার দায়ভার কবিরা নিতে চায় না। কিন্তু সে মায়াবিনী। মোহ তার অলঙ্কার।

এ পর্যন্ত আমি যত বই-পুস্তক, প্রাচীন পান্ডুলিপি এবং ধুসর হয়ে যাওয়া মানব কাহিনী অধ্যয়ন করেছি এর মধ্যে সবটাই কোনো না কোনো মায়াবিনী নারীর নিঃশব্দ প্রতারণা। সে ঠকায় কিন্তু বলে না। সে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। কিন্তু তার চোখ কল্পহীন থাকে। সে কাঁদে না, কিন্তু অন্যকে কাঁদায়। সে হাসে; কিন্তু হাসির মধ্যে কোনো বিশ্বাসের ছিঁটেফোটা থাকে না।

তবে কারো কারো সঙ্গে এই ছলনাময়ী ছলচাতুরি করতে গিয়ে পৃথিবীর মাটিতে পা পিছলে পড়ে যায়। আর উঠতে পারে না। দয়াপরবশ হয়ে কেউ তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলে সেই সাহায্যকারীর ঋণ সে কখনো স্বীকার করে না। তবে অস্বীকারও করে না। সে স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির মধ্যবর্তী সত্তা। পুরুষ চিরকাল প্রকাশ্যে ফাঁকি দিয়ে পালাতে চায়। এটা সবচেয়ে ভালো জানে নারীরাই। পুরুষ ধরা পড়ে যায়। শাস্তি ভোগ করে। লজ্জাই তার শাস্তি।

মর্যাদা হারিয়ে পুরুষ বাঁচতে চায় না। কিন্তু নারীরা একবার সম্ভ্রম হারালে সে চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। তবুও তার মহৎ কিছু গুণ আছে। এজন্যই পুরুষের নারী না হলে জীবন ধুসর মরুভুমিতে পরিণত হয়। এই গুণগুলোর মধ্যে একটা হলো সে পুরুষকে সহজে ভেঙে পড়তে দেয় না। সে সান্ত্বনা দেয়, সাহস জোগায় এবং পুনরায় অসম্ভব কোনো কর্মের জন্য পুরুষকে সম্ভবপর করে তোলে। পুরুষ সাহসী হয়ে অজেয়কে জয় করতে পুনর্বার অভিযান চালায়। প্রায়শই পুরুষ বিজয়ী হয়। এই অদম্য পুরুষকে নারীরা সহ্য করতে পারে না। ভাবে, কেন সে বিজয়ী থাকবে? কেন সে পরাজয় মানবে না? অন্তত আমার কাছে তো সে বারবার বেহায়ার মতো আসতেই থাকে। এই দ্বন্দ্ব চিরকালের।

এর নিরসন হয় না বলেই সাহিত্য সম্ভব হয়েছে। মানব মনে কাজের ঝঙ্কার ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলেই সে স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন দেখায়। তবে কে না জানে, মেয়েরা মাতৃত্বের এক অসাধারণ গুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সবই পরাজিত সত্তা। কিন্তু মাতৃত্ব অর্থাৎ নারীর মা হওয়ার গৌরব অপরাজিত। অসতী মাকেও সন্তান মা বলে জড়িয়ে ধরতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। মা তো মা-ই। এর কোনো রকমফের হয় না। আর কে না জানে, মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের বেহেশত।

এহেন নারীকে অনেক সময় পুরুষরা বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছে। ভেবেছে এটা একটা বাড়তি বোঝা। এ নিয়ে সর্বত্র চলা যায় না। কিন্তু কোনো বিশ্রামই পুরুষের নারীর সহযোগিতা ছাড়া পুর্ণতা পায় না। আমরা এ কঠিন বিষয়ের নাম দিয়েছি প্রেম। গালভরা নাম সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ভেতরটা আসলে দাহ্য বস্তুর মতো কেবলই জ্বলছে। যদিও প্রকাশ্যে কোনো কিছু দগ্ধ হচ্ছে না। সে আগুন জ্বলে যায় দহে না কো কিছু।

— আল মাহমুদ

One response to this post.

  1. আসলে আপনার সব লেখাই আমার কাছে ভালো লাগে

    Reply

Leave a comment