কাল বহমান, জবাবহীন


নেক জায়গায় আমার যেতে ইচ্ছা করে। এই শহরেরই এমন বহু জায়গা আছে, আমি যেতে পারলে খুশি হয়ে উঠি। এখন অবশ্য আমি নিজে কোথাও একাকী যেতে পারি না। চেষ্টাচরিত করে কারো হাত ধরে সেখানে গেলেও, সেই আগের আনন্দ ও অনুভুতি আর ফিরে আসে না। কষ্ট করে গেলাম হয়তো পরিচিত জায়গায়। জায়গাটা ঠিক আছে। আমার পায়ের নিচেই আছে। কিন্তু সময়টা চলে গেছে। যে সময়কে ভেবে আমি যাই, সেই সময় সেখানে আর আমার জন্য বসে থাকেনি। বুঝতে পারি, সময়টাই ছিল আসল সত্য; জায়গাটা নয়। সবই ঠিক আছে। অনেকটা নদীর মতো। স্রোত গড়িয়ে গেছে। অথচ সেই পুরনো ঘাটলাটা পড়ে আছে। কত বধু নাইতে নেমেছে। কলস ডুবিয়ে কোমর বাঁকা করে বয়ে নিয়ে গেছে নদীর পানি। কিন্তু স্রোত চলে গেছে বধুটিকে ঘাটলায় ফেলে।
কবি হৃদয়ের আক্ষেপ হলো, স্রোত চলে যাওয়ার পরেও সে ঘাটলায় নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করে বসে থাকে। নদী কথা কয় না। যদিও ঢেউ ছল ছল করে।

সারাজীবন এই ঢেউয়ের ছলছলানি কানে গুঁজে আমি ঘাটলায় বসে থাকতাম। কেউ জিজ্ঞেস করল না, আমি কার জন্যে বসে আছি। আমিও কি জানি, আমি কার জন্যে বসে আছি?

একবার মনে হয়েছিল, আমি বুঝি আমার জন্যই বসে থাকি। কিন্তু ভেতরকার আমি আমাকে গালমন্দ করে জানিয়ে দিল, আমি যার জন্যে বসে আছি, তাকে আমি একবারই দেখেছিলাম। আরো একবার দেখব এই আশায়। কিন্তু আমার ভেতরকার আমি একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, সে আর আসবে না। একবারই আসে। তবে সৌভাগ্যবান মানুষ হলে তার একবারের আসাটাকেই অনেকবার আসার মতো করে সময়ের ওপর সময়কে ধরে রেখে ছবি বানিয়ে বাঁধিয়ে রাখে। আমারও একবারই সুযোগ হয়েছিল। আমিও ছবি বানিয়েছি। কিন্তু বাঁধিয়ে রাখতে গিয়ে দেখি, কাঠ-ফ্রেম-পেরেক কোনো কিছুই কাজ করছে না। কারণ সবাই বলে, সময়কে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার জোগান আমার ঠিকমত হয়নি। তাছাড়া যাকে বাঁধিয়ে রাখব, তার হাত-পা, চাহনি-চতুরতা বার বার ফ্রেমের বাইরে চলে আসছে। অথচ আমি সারাবেলা বন্ধনলীলা নিয়ে ব্যস্ত থেকে যাকে বাঁধব তার পুর্ণ সৌন্দর্য ধারণায় আনতে পারিনি। আমি শুধু পেতে চাই। খেতে চাই। কিন্তু একটু আগ বাড়িয়ে যেতে চাই না।

এভাবে তো, বলা যায়, এক রকম দিন কাটিয়েই দিলাম। খুব একটা খারাপ কাটিয়েছি-এটা আমি বলি না। সুখে না বললেও আমি তো জানি দিবস-রজনী আমার তেমন সচ্ছল ছিল না। যদিও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। আমি ছন্দ মেলাতে জানি, অন্তঃমিল জানি, ভেতরকার মিলও কমবেশি শিখেছি। কিন্তু আসল সত্য হলো, আমি গুছিয়ে শেষ করতে জানি না। আমার কোনো কিছুই শেষ হয় না কেন? এর কারণ আমি সবাইকেই জিজ্ঞেস করেছি। গাছপালাও বাদ যায়নি। মনে হয়, জবাবটা সবাই জানে। কেবল আমিই জানি না। সবার মুখে একটা হাসি দেখেছি আমাকে নিয়ে। না বিদ্রুপের হাসি নয়। সহানুভুতিও একে বলা যায় না। জানি না এর নাম কী দেব। যে মেয়ে কথায় কথায় হাসে, আমরা কবিরা তার নাম দিয়েছি দেখনহাসি। কিন্তু এ হাসি তো তেমন হাসি নয়। আমার মনে হয়, আজ পর্যন্ত কেউ এই বিশেষ হাসিটির নাম নির্ধারণ করে যাননি।

এই লাজরক্তিম হাসিটি আমি এতদিন পরে বুঝতে চাই। কিন্তু যার কাছে বুঝতে চাই, সে এ কথা বললেই আমাকে এড়িয়ে গিয়ে বিদায়ের প্রার্থনা করে। বলে, অনেক বেলা হয়ে গেল তো। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। তুমি ভালো থাক। আমি যাই। এ ভালো থাকার কথাটা আমি বহু সহ্য করেছি। এখন এটা শুনলে কানের ভেতর দিয়ে হৃদয় ভেদ করে অশ্রুজল হয়ে চোখ ভাসিয়ে দেয়। কেন আমি ভালো থাকব? কে আমাকে ভালো রেখেছে? আঘাতে আঘাতে জর্জরিত একটি সত্তা কীভাবে ভালো থাকবে? আর একটি বড় কথা, সবাই যখন বিব্রত অবস্হায় আছে এবং মুখ ফিরিয়ে রেখেছে আমার দিকে, তখন আমি যে অবস্হায় আছি, সে অবস্হাকে কে নাম দিল ভালো অবস্হা? আমি শুধু বলি, আমি আছি। আমার অস্তিত্বটাই কেবল আমি নই। আমি বলতে তো আমার কর্মকেও বোঝায়। আমার কাজ, আমার কর্তব্য, আমার কাব্য, আমার কথকতা-সবটা মিলিয়েই আমি।

এভাবেই তো দিবস-যামিনী অতিক্রান্ত হতে হতে আমি আমার সময়ের অন্তিমে এসে দাঁড়িয়েছি। কেউ যদি বলে জগত-সংসারকে কী দিলাম? তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে আমার কোনো জবাব নেই বটে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটা হলো, কী নিলাম। পরের দুর্নাম রটায় এমন লোক বলবে, আমি নিয়েছি প্রচুর। এসব নিয়ে তর্ক চলে না। শুধু দেখছি আমার হাতে এক মহাশুন্যতা আয়ুরেখা হয়ে পড়ে আছে।

সব কিছুর পারিশ্রমিক ঘাম শুকানোর আগেই পাওয়া যায়। কেবল কাব্যের মুল্যটা ঘাম শুকানোর আগে কেউ কি মিটিয়েছে? কিন্তু ওই একটি ক্ষেত্র আছে, যেখানে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। কারণ জবাবটা সবারই জানা। পরিণামটাও অজানা নয়। এ অবস্হায় জগতের সবচেয়ে স্বাধীন মানুষকে নিয়ে এ প্রশ্ন এসে যায়। আমি দার্শনিকতায় যেতে চাই না। আমি নিজেকে যেমন কবি ভাবি, তেমনি নিজের পরিণামও কবিত্বের কুয়াশায় আবৃত থাক, সেটা আশঙ্কা করি। আমি লেখক হয়ে জন্মেছি। লেখকের মতোই অবসান কামনা করি। কারো ক্ষতি আমার কাম্য নয়। যাদের কাছে একদা কিছু পেয়েছিলাম, তারা তাদের নামোল্লেখ পছন্দ করবেন না, এটা আমি জানি। আর এদের বিব্রত করা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। তবু মানুষের কাহিনী কি শেষ হয়?
এই কলামটিতে সেই কাহিনী সাধ্যমত লিখব বলে মন স্হির করেছি।

কাউকে বিব্রত করার জন্য নয়। কাউকে বিস্মিত করার জন্যও নয়। আমি লিখব আমার বিবেকের তাড়নায়। সাহিত্যজীবনে অনুদঘাটিত কোনো তথ্য থেকে যাক, সেটা আমি চাই না। কারণ আমরা তো কেবল বলার জন্যই জন্মেছি। কথা জমা রাখার কোনো আড়াল আমাদের প্রয়োজন হয় না। তবুও মানুষের জীবন এতটাই রসহ্যময় যে, এর কোনো কুলকিনারা পাওয়া যায় না। যে কথা এই মুহুর্তে বলার যোগ্য বলে বিবেচনা করতে পারি না, সেটাই যে অখন্ডনীয় ইতিহাস হয়ে উঠবে না-সেটা কী করে জানি?

লেখকঃ কবি, কথাশিল্পী আল মাহমুদ
(সূত্রঃ আমার দেশ, ২৮/০৪/২০০৯)

Leave a comment